ভোটের হিসাব পাল্টে দিতে পারে তিন কোটি তরুণ ভোটার গত এক দশকে দেশে ভোটার বেড়েছে সোয়া ৩ কোটি, যাদের বয়স কিনা ১৮ থেকে ২৯ বছর। আর তাদের জীবনে তিনটি জাতীয় নির্বাচন এলেও স্বাদ পাননি ভোটাধিকার প্রয়োগের।
কেননা ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হয়েছে রাতের ভোট। আর ২০২৪ সালে হয়েছে ডামি নির্বাচন।
স্বাধীনতা পরবর্তী এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের মধ্য দিয়ে কোনো রাজনৈতিক সরকারকে হটিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে তরুণরা ক্ষমতায় এনেছেন নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে চলছে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার কার্যক্রমও। ইতোমধ্যে গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতৃত্বে থাকা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গড়েছেন নতুন দল- জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সবারই প্রত্যাশা গত তিনটি নির্বাচনকে অতীত করে দিয়ে একটি স্বচ্ছ, সুন্দর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আর সে মোতাবেক নির্বাচন হলে ফলাফলের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে সেই ভোটাররা।
নির্বাচন কমিশন (ইসি), রাজনৈতিক দল, বিদেশি রাষ্ট্রগুলো থেকে শুরু করে দেশের আপামর মানুষ ভোট দেওয়ার স্বাদ নিতে মুখিয়ে আছে। অনেকেই বলছেন, দ্রুত নির্বাচন দিয়ে সরকারের উচিত দেশবাসীর ভোটাধিকার প্রয়োগের অপেক্ষাকে আর দীর্ঘায়িত না করা। ইতোমধ্যে সরকার আগামী ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা বলেছে। আর সে অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন তার প্রাথমিক প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন ইতোমধ্যে বলেছেন, আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছি ডিসেম্বরকে টার্গেট করে। আশাকরি সবার সহায়তায় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারবো।
প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেছে। এছাড়াও তরুণদের সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টির জন্য বাড়িবাড়ি ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম চলমান রেখেছে, যা জুনে শেষ হবে। নতুন দল নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। চলছে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নির্বাচনি আচরণ বিধিমালা, পর্যবেক্ষক নীতিমালা সংশোধনের কাজও।
সর্বশেষ গত হালানাগাদ অনুযায়ী, বর্তমানে ১৮ থেকে ২৯ বয়সী ভোটার তিন কোটি চার লাখ সাত হাজার ৯৮৬ জন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৯৩ লাখ।
এবার ৩০ থেকে ৩৩ বয়সী ভোটারের সংখ্যা এক কোটি পাঁচ লাখ ১৩ হাজার ৯৫২ জন, গতবার এই বয়সী ভোটার সংখ্যা এক কোটি পাঁচ লাখের মতো ছিল।
৩৪ থেকে ৩৭ বছর বয়সী ভোটার সংখ্যা এক কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার ১৮৪ জন, গতবারের চেয়ে এই বয়সী ভোটার সংখ্যা এবার দশ লাখের মতো কম।
৩৮ থেকে ৪১ বছর বয়সী ভোটার সংখ্যা এবার এক কোটি ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৩৩২ জন, গতবার ছিল এক কোটি ২২ লাখ।
এদিকে ৪২ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ভোটার সংখ্যা এবার এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৯২৯ জন, গতবার ছিল এক কোটি ছয় লাখ।
৪৬ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ভোটার সংখ্যা এবার ৮৯ লাখ ১২ হাজার ২৭৭ জন, আগেরবার যা ছিল ৬৩ লাখ।
৫০ থেকে ৫৩ বছরের মধ্যে এবার ভোটার সংখ্যা ৭৬ লাখ ১৯ হাজার ৮১৮ জন, গতবার ছিল ৮৩ লাখের মতো।
৫৪ থেকে ৫৭ বছরের মধ্যে এবার ভোটার সংখ্যা ৭৪ লাখ আট হাজার ৯৮৩ জন, গতবার ছিল ৬৭ লাখ।
৫৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে এবার ভোটার সংখ্যা ৩৪ লাখ ৩৩ হাজার ৪৬৭ জন, যা আগেরবার ছিল ৪০ লাখ।
এবার ষাটোর্ধ্ব ভোটার সংখ্যা এক কোটি ৮৬ লাখ ২৭ হাজার ৬১৬ জন, গতবার যা প্রায় একই ছিল। এছাড়া ১৭ বছর বয়সী কিছু নাগরিকের তথ্য রয়েছে, যারা আগামী নির্বাচনের সময় ভোটার তালিকায় যুক্ত হবেন, এদের সংখ্যা হচ্ছে ১৪৩জন। সবমিলিয়ে এবারের ভোটার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে কমপক্ষে ১২ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ছয় কোটি ৩৪ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭৮জন, নারীর সংখ্যা ছয় কোটি ১০ লাখ ২১ হাজার ১৪২ জন। হিজড়া রয়েছে এক হাজার ৬৭ জন।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় ভোটার সংখ্যা ছিল নয় কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ জন। সেই হিসেবে এক দশকে ভোটার বেড়েছে তিন কোটি ২৫ লাখ ১৫ হাজার ৫২০ জন। ওই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় লাভ করেছিল। ভোট দিয়েছিলেন এক কোটি ৭৩ লাখ ৯২ হাজার ৮৮৭ জন। এই নির্বাচন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্জন করেছিল।
এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচন এলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিজেদের জয় নিশ্চিত করেন। ওই নির্বাচনে ভোটার ছিল ১০ কোটি ৪১ লাখ ৫৬ হাজার ২৬৯ জন। এদের মধ্যে ভোট পড়েছিল আট কোটি ৩৫ লাখ ৩২ হাজার ৯১ জন, যা মোট ভোটের শতকরা হার ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজের ঘরে তুলে নিয়েছিল ছয় কোটি ৩৫ লাখ ২৩ হাজার ৬৬ ভোট। দলটি মোট ২৬৬ আসনে নিজেদের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করেছিল। আর বিএনপি ও জোট পেয়েছিল মাত্র সাতটি আসন। এই নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়েছিল ২১৩টি কেন্দ্রে।
এদিকে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ভোট বর্জনের নীতির মধ্যে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে একই দলের নেতারা। এজন্য অনেকেই এই নির্বাচনকে ডামি নির্বাচন আখ্যা দেয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ভোটার ছিল ১১ কোটি ৮৯ লাখ ৮৯ হাজার ২৪১ জন। ভোট পড়েছিল চার কোটি ৯৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪৬৭ ভোট। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ তিন কোটি ২১ হাজার ২০০ ভোট নিজেদের ঘরে তুলে নিয়ে জয়ী হয় ২২২ আসনে।
এই তিনটি নির্বাচনের কোনোটিতেই তরুণরা ভোটের স্বাদ নিতে পারেনি বলে মনে করছেন অনেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, তিনটি ভোটই হয়েছে ভোটকেন্দ্র দখল করে। বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীরা অনেকে কেন্দ্রে অবস্থানই নিতে পারেনি। ছিল না তাদের এজেন্টরাও। তবে এবার সুষ্ঠু ভোট হলে তরুণ ভোটাররা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ও ঢাকা ইন্টারন্যাশল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারি এ বিষয়ে বলেন, নির্বাচনে তরুণদের ভূমিকা প্রায় সব সময় ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গত তিনটি নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারেননি। এদিকে বিরাট একটি গণঅভ্যুত্থান করে ফেলেছে তারা। তাই যদি সুষ্ঠু ভোট হয়, তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তারা।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, তরুণরাই একটি সফল আন্দোলন করে একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারকে বিদায় করে দিয়েছে। কাজেই সুষ্ঠু ভোট হলে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন তো হবেই। এক্ষেত্রে তারাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।