গাজীপুরে চারটি বাগানবাড়ির সন্ধান মিলছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা পরিবারের সদস্যদের নামে। বিগত সরকারের আমলে কেনা এসব বাগানবাড়ি ব্যবহৃত হয় অবসর কাটানোর জন্য। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর চারটি বাগানবাড়িতেই বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালায়, আগুন দেয়, করে লুটপাটও। তাই এখন আগের মতো সেই জৌলুস নেই সেসব বাগানবাড়ির।
জানা গেছে, এসব বাগানবাড়িতে বিভিন্ন সময় শেখ পরিবারের সদস্যরা আসতেন। যে তালিকায় শেখা হাসিনা, শেখ রেহানা, তার ছেলে ববি, মেয়ে টিউলিপও ছিলেন। এসব বাগানবাড়িতে হতো বিচার সালিশও। সরকারি গাড়িতে কেউ আসলে বাগানবাড়িগুলো ঘিরে ফেলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কে ঢুকতো সে সম্পর্কে জানতো না স্থানীয়রা। শুধু শুনতো।
স্থানীয়দের কোনোদিন সৌভাগ্য হয়নি এসব বাগানবাড়িতে ঢোকার। তবে দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর কৌতূহলবশত অনেকেই বাগানবাড়িগুলোতে যান।
স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এসব বাগানবাড়ি শেখ রেহেনার স্বামী সফিক আহাম্মেদ সিদ্দিক, তার দেবর তারিক আহাম্মেদ সিদ্দিক ও রফিক আহাম্মেদ সিদ্দিকের।
জানতে চাইলে গাজীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) নাফিসা আরেফীন বলেন, জমির বিষয়টি কেবলই আলোচনায় এসেছে। এখন ইজতেমা নিয়ে ব্যস্ত তাই ইজতেমার পর বিষয়টি নিয়ে আমারা কথা বলব।
টিউলিপ টেরিটরি
গাজীপুর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কানাইয়া এলাকা। কাঁচা-পাকা রাস্তা আর সারি সারি গাছপালা। সবুজে ঘেরা এ কানাইয়া এলাকার ৩৫ বিঘা জমির ওপর রয়েছে ‘টিউলিপ টেরিটরি’ নামের বাগানবাড়িটি। নান্দনিক ও প্রকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাগানবাড়িটিতে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, সান বাঁধানো পুকুর ঘাট, কৃত্রিম ও প্রকৃতিক জলরাশি বেষ্টিত। নাগরিক জীবনের কোলাহল ছেড়ে অবকাশ যাপনের জন্য সেরা স্থান।
টিউলিপ টেরিটরির ম্যানেজার আব্দুর রহমান বলেন, ‘এই বাগান বাড়ির মালিক শফিক স্যার। এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। প্রতি বছর শীতের সময় টিউলিপ আপা, ববি ভাইসহ কয়েকজন আসতো। চার থেকে পাঁচদিন থাকতো। তারা যখন আসতেন সঙ্গে বিপুল সংখ্যক পুলিশ বাগাবাড়ি নজরদারিতে রাখতো।’
বাগান বিলাস
মহানগরীর বাঙ্গালগাছ এলাকায় প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে তৈরি করা বাগানবাড়ির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাগান বিলাস’। শতশত গাছ লাগানো হয়েছে সেখানে। অবকাশ যাবনের জন্য করা হয়েছে তিন রুমের একটি দোচালা ঘর। পাশেই আরেকটি ছোট্ট ঘর। সামনে রয়েছে বিশাল এক পুকুর। রয়েছে বিল ও পুকুর দেখার জন্য ওয়াচ টাওয়ার।
বাগান বিলাস দেখবাল করেন মো. হৃদয় নামের এক ব্যাক্তি। তিনি বলেন, ‘এটি সবাই জানে শেখ রেহানার বাংলো। কিন্তু এটি আসলে তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে হুট করে অনেক লোক প্রবেশ করে। এরপর সবকিছু ভাঙচুর করে লুটপাট করে নিয়ে গেছে। অনেক ভিআইপি আসতেন এখানে। শুনেছি শেখ রেহানা এসেছেন। তবে আমি আসার পর তাকে আসতে দেখিনি।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, বাগান বিলাসে অনেক বিচার সালিশ হতো ভেতরে। ভাঙচুর হওয়া ঘরের সামনে বেশ কয়েকটি বিদুৎ বিলের কাগজ পাওয়া যায়। সেই বিলে মিটারের মালিকের নাম হিসেবে দেওয়া রয়েছে তারেক সিদ্দিকের নাম। তবে বাগান বাড়ির গেইটে যে নাম ফলকটি রয়েছে সেখানে লেখা রফিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম।
ফাওকালের বাগানবাড়ি
গাজীপুর মহানগরীর ফাওকাল এলাকায় রয়েছে বাংলাদেশ সমরাস্ত্র ও টাকশাল। এর পাশেই ২৩ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাগানবাড়ি। বিশাল সীমানা প্রাচীরে ঘেরা, ভেতরে নান্দনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি। সেটিকে আগে স্থানীয় মানুষজন ডাক্তার বাড়ি হিসাবে চিনতেন। ২০১২ সালে অনিল কুমার ও অক্ষয় কুমার বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে কিনে এই বাগানবাড়ি তৈরি করা হয়েছে।
৩৫ লাখ টাকা বিঘা মূল্য ১৪ বিঘা জমি কেনেন শেখ রেহেনার দেবর তারিক সিদ্দিক। কাগজপত্রে সমস্যা থাকায় আট বিঘার দাম দেওয়া হয়নি। জমিটি স্বাপন মিয়া নামের স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ীর মধ্যস্ততায় কেনা হয়। ওই বাগানবাড়িতে মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রোটোকল নিয়ে ভিআইপিরা আসতেন বলে জানান স্থানীয়রা।
অক্ষয় কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘এটি আমাদের বাপ-চাচার জমি ছিল। পরে আমরা বেচার সিদ্ধান্ত নিলে তারিক সিদ্দিক ২০১৫ সালে কিনে নেন। ২৩ বিঘা জমি থাকলেও কাগজপত্র সমস্যা থাকার কারণে ১৪ বিঘার দাম দেয়। বাকি আট বিঘার দাম দেয়নি। এখন সেখানে বাংলো বানিয়েছে। জমির দামও বেড়েছে কয়েকগুণ।’
তেলিরচালা বাগানবাড়ি
গাজীপুর শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মৌচাকের তেলিরচালা এলাকা। সেখানে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষে ১৫ বিঘার ওপর নির্মাণ করা হয় নান্দনিক বাগানবাড়ি। প্রতি বছর শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা একান্ত সময় কাটাতে সেখানে আসতেন। গত বছরের এপ্রিলেও তারা এসেছিলেন এখানে। বাগান বাড়িটি দেখভাল করতেন কালিয়াকৈর উপজেলার পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তার বাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়।
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব মোহাম্মদ কায়সার খসরু বলেন, গাজীপুর শেখ রেহেনার পরিবারের বাংলোবাড়িসহ অনেক জমিজমা রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। দুদক থেকে এখনও কোনো চিঠি আসেনি। দুদক পত্রের মাধ্যমে জানতে চাইলে আমরা তথ্য প্রমাণসহ প্রতিবেদন পাঠাবো।